গ্যাস্ট্রো ইজোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ বা জিইআরডি। খটমটে শব্দ বটে, তবে আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই কমবেশি ‘রিফ্লাক্সের’ অভিজ্ঞতা আছে। সহজ ভাষায় বললে, ঢেকুর তুললে মুখের মধ্যে টক বা তেতো স্বাদ অনুভব করা বা কখনো বুক জ্বালাপোড়া করা—এসবই হলো রিফ্লাক্সের লক্ষণ। আর এ ধরনের উপসর্গ সপ্তাহে দুই বা ততোধিকবার হলে তাকে গ্যাস্ট্রো ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ বলা হয়। বিশ্বের ১৪ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভুগে থাকেন।
কেন হয় জি ই আরডি
আমাদের খাদ্যনালি ও পাকস্থলীর সংযোগস্থলে একটি ভাল্ব বা বৃত্তাকার পেশির তৈরি রিং আছে, যার নাম লোয়ার ইসোফেজিয়াল স্ফিংটার। এই ভাল্বের কাজ হলো খাবার খাদ্যনালি থেকে পাকস্থলীতে প্রবেশের সময় শিথিল বা প্রসারিত হওয়া, আবার খাবার পাকস্থলীতে প্রবেশ করার পর শক্তভাবে এর মুখ আটকে দেওয়া। কোনো কারণে এর কার্যকারিতা হ্রাস পেলে পাকস্থলীর অ্যাসিড মিশ্রিত পাচক রস ও খাবারের অংশ ওপরে ঠেলে খাদ্যনালিতে চলে আসে আর বুক জ্বালাপোড়া বা অস্বস্তি সৃষ্টি হয়।
জিইআরডির সঠিক কারণ সব সময় স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও কিছু বিষয়ের ঝুঁকি বাড়ায়।
অ্যাসিড রিফ্লাক্সের অন্যতম কারণ হলো হায়াটাস হার্নিয়া। এতে খাদ্যনালি ও পাকস্থলীর উপরিভাগ বুকের মধ্যচ্ছদা বা ডায়াফ্রামের ওপরে উঠে আসে। কখনো স্ফিংটারের পেশি শিথিল হয়ে পড়লে বা পেটের চাপ অতিরিক্ত বেড়ে গেলে জিইআরডি হতে পারে।
ঝুঁকিগুলো কী?
স্থূলতা, গর্ভধারণ, ধূমপান, মদ্যপান, অতিরিক্ত পেট ভরে খাবার বা পানি গ্রহণ করার পর পর শুয়ে পড়া অথবা কাত হয়ে বা উপুড় হয়ে শোয়ার ফলে রিফ্লাক্স হয়। কার্বনেটেড পানীয় (যেমন কোমল পানীয়) বা চা-কফি বেশি পান করলে কিংবা মসলা ও চর্বিযুক্ত খাবার, চকলেট, অতিরিক্ত টক জাতীয় খাবার খেলে ঝুঁকি বাড়ে। অ্যাসপিরিন, ব্যথানাশক, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, মাসল রিলাক্সেন্ট জাতীয় ওষুধ সেবনে সমস্যা বাড়ে।
জিইআরডির সমাধান দরকার
জিইআরডির কারণে দৈনন্দিন জীবনযাপনে অস্বস্তি ও কষ্ট তো হয়ই, এটির চিকিৎসা না করালে কিছু জটিলতা হতে পারে। খাদ্যনালির প্রদাহ বা বেরেটস ইসোফেজাইটিসের অন্যতম জটিলতা। প্রায় ১৫ শতাংশ রোগীর এ ধরনের প্রদাহ হয় যা পাকস্থলীর ক্যানসারের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া এ থেকে হাঁপানি, নিউমোনিয়া, শ্বাসনালির প্রদাহ, কণ্ঠনালির প্রদাহ, ঘুমের সমস্যা (স্লিপ এপনিয়া) ইত্যাদি হতে পারে।
তাই রিফ্লাক্স বা জিইআরডির সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
প্রতিকার
- জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এনে জিইআরডি থেকে অনেকাংশে সুস্থ থাকা সম্ভব।
- একসঙ্গে অতিরিক্ত পেট ভরে না খেয়ে সারা দিনে অল্প অল্প করে খেতে হবে।
- ধূমপান অবশ্যই বর্জন করতে হবে।
- বেশি বেশি কফি, জুস, কোমল পানীয়, অ্যালকোহল সেবন বন্ধ করতে হবে।
- খাবার গ্রহণের দুই-তিন ঘণ্টা পর বিছানায় যাবেন।
- বিছানার মাথার দিকটি ৬-৮ ইঞ্চি উঁচু করে দিতে পারেন। খাবার পর দরকার হলে হেলানো চেয়ারে বসতে পারেন।
- ঘন ঘন দাওয়াত, বাইরের খাবার, ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন।
- আঁটসাঁট পোশাক ও শক্ত বেল্ট পরিহার করুন।
- শরীরের ওজন বেশি হলে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়ামের সাহায্যে ওজন কমান।
- যেসব ওষুধ সমস্যা বাড়ায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেগুলো পরিবর্তন করা যায় কি না, দেখুন।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন এনে সমস্যা না মিটলে চিকিৎসক আপনাকে উপসর্গ কমাতে কিছুদিনের জন্য অ্যান্টাসিড, এইচটু ব্লকার, পিপিআই (প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরস), সোডিয়াম অ্যালগিনেট বা ডমপেরিডোন জাতীয় ওষুধ দিতে পারেন। তবে তীব্রতা বাড়তে থাকলে বা সমাধান না হলে কিছু ক্ষেত্রে এন্ডোস্কপিক বা সার্জিক্যাল চিকিৎসাও প্রয়োজন হতে পারে।
অধ্যাপক ডা. চঞ্চল কুমার ঘোষ
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।