human-brain-and-journey-of-neuron

নিউরন ॥ এ জার্নি অব ব্রেইন Leave a comment

ধরা হয় মানব মস্তিষ্কে গড়ে আশি থেকে একশ’ বিলিয়ন নিউরন থাকে। প্রাণীদের মধ্যে আফ্রিকান হাতির মস্তিষ্কে সবচেয়ে বেশি নিউরন থাকে। প্রায় ২৫০ বিলিয়ন। যদিও সবচেয়ে বড় ব্রেইন থাকে শিকারি জাতের তিমি মাছের। ওজনে ১০ কিলোগ্রাম। আফ্রিকান হাতির ব্রেইনের ওজন গড়ে ৬ কিলোগ্রাম হলেও সবচেয়ে বেশি নিউরন থাকে। সবচেয়ে ছোট ব্রেইন হয় এক জাতের বাদুড়ের। ওজনে মাত্র ৭৪ মিলিগ্রাম। মানব মস্তিষ্কের গড় ওজন দেড় কিলোগ্রাম। যদিও পুরুষ এবং নারীর ব্রেইনের ওজনের পার্থক্য হয় দেড় থেকে দুই কিলোগ্রামের মতো। মানব পুরুষের ব্রেইনের ওজন বেশি থাকে। হয়তো সেটা শরীরের আয়তনের সঙ্গে বেড়ে যায়। যদিও কার্য দক্ষতায় নারী পুরুষের ব্রেইনের কোন পার্থক্য নেই। বরং বয়স বাড়লে বছরে গড়ে দুই গ্রামের বেশি করে ব্রেইনের ওজন কমতে থাকে। কারণ, বয়স বাড়লে ব্রেইনের কোষ বা নিউরন মরে যায়, কমে যায় এবং ব্রেইন সঙ্কুচিত হয়।

জন্মের সময় প্রতিটি মানব শিশু যে পরিমাণ ব্রেইন সেল বা নিউরন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে, সেটি আর কখনও বাড়ে না বলে ধারণা করা হয়। সংখ্যায় এটি একশ’ বিলিয়নের মতো। বয়স বাড়লে এটি একটির সঙ্গে আরেকটি সংযোগ তৈরি বাড়ে, সংখ্যায় বাড়ে না। বিলিয়ন নিউরন থেকে সারা জীবনে জন্ম হয় ট্রিলিয়ন সিনোপসিস বা সংযোগ। যদিও একটি কন্ট্রোভার্সিয়াল তত্ত¡ গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে চালু যে, ব্রেইনের একটি জায়গা এতে ব্যতিক্রম। পরীক্ষা করে দেখা গেছে মধ্য ব্রেইনের হিপোক্যাম্পাস নামের একটি অংশে প্রাপ্ত বয়স্ক সময়ে দৈনিক ১৪০০ নিউরনের জন্ম হয়। এই তত্তে¡র পক্ষে বিপক্ষে কথা আছে। ব্রেইনে আবার কিছু প্রাণী আছে, যাদের একটি ব্রেইন থাকে না। যেমন জোঁক! জোঁকের ৩২ টি ব্রেইন। যদিও অধিকাংশ প্রাণীর একটি ব্রেইন।

আমাদের শরীর যা দিয়ে তৈরি তার ক্ষুদ্রতম ইউনিট বা এককের নাম সেল বা কোষ। একটা সময়ে ধরা হতো এবং এখনও কেউ মনে করেন- মানব শরীরের গড়ে ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ থাকে। অনেকে তাকে ৭০০ ট্রিলিয়নের উপরে দিতে রাজি নয়। বিতর্ক এখানেই শেষ নয়। একদল মনে করেন মানব শরীরে মোট কোষের সংখ্যা গড়ে ৩০ ট্রিলিয়নের বেশি নয়। সংখ্যা যেটাই থাকুক, কোষগুলোকে কখনও কাজের ওপর, কখনও গঠনের ওপর, কখনও শরীরের অংশের ওপর ভিত্তি করে দুই ভাগ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ ভাগ পর্যন্ত করা হয়। মস্তিষ্কের অংশে এবং শরীরের স্নায়ু অংশে যে কোষগুলো কাজ করে তাদের এক নাম নিউরন বা স্নায়ু কোষ বলে।

শরীরের স্নায়ু কাজকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে সিস্টেমকে বলে নার্ভাস সিস্টেম। আর এই সিস্টেম ইটের মতো যা দিয়ে তৈরি সেটাই নিউরন। এই নিউরনের কাজ কেমিক্যাল এবং ইলেক্ট্রিক্যাল সিগন্যাল এক নিউরন থেকে আরেক নিউরনের মধ্যে দিয়ে শরীরের গন্তব্যে পৌঁছানো। একটি নিউরনের তিনটি পার্ট- মূল শরীর, অসংখ্য হাত এবং একটি পা। মূল শরীর থেকে হাতের মতো অংশগুলোকে বলে ডেনড্রাইট, কেবল একটি পায়ের মতো অংশকে বলে এক্সন। শুনতে যতটা সরল শোনায়, একটি নিউরন অতো সরল নয়। মস্তিষ্কের সকল জটিলতা নির্ভর করে এই নিউরনের ওপর। এই একটি নিউরনের ওপর। তাই নিউরনের এই জটিলতা ভাঙতে এবং বুঝতে পারাই মস্তিষ্কের জটিলতা ভাঙা এবং বুঝা।

ব্রেইনের নিউরনের কানেকশনকে বলে নিউরাল নেটওয়ার্ক। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর মানুষের মস্তিষ্কের গঠনের আদলে আর্টিফিশিয়াল মেশিন তৈরির ধারণা প্রথম আসে। জন্ম হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ধারণাটি। মস্তিষ্ক যেমন করে কাজ করে ঠিক তেমনিভাবে একটি মেশিন বানাতে পারলে মস্তিষ্কের হাজার গুণ বেশি কাজ করতে পারবে সেটি। মস্তিষ্কের লার্নিং প্রসেস এলগোরিদমিক লার্নিং প্রসেসকে কপি করে ইন্টারকানেক্টেড নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে তাই চেষ্টা চলছে ডিপ লার্নিং মেশিন তৈরির। সত্তর বছর আগে বায়োলজিক্যাল নিউরন থেকে ধারণার জন্ম নিয়েছিল মেশিন নিউরনের, যার নাম দেয়া হয়েছিল পার্সেপট্রন। আজকের কম্পিউটেশনাল কমপ্লেক্স নেটওয়ার্ক তারই ফসল। সেটাকে আরও এগিয়ে নিতে বায়োলজিক্যাল নিউরনকে বুঝতে জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৫২ সালে কম্পিউটারের জনক ব্রিটিশ ম্যাথমেটিশিয়ান এ্যালেন টুরিং যে তত্তে¡র মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কের নিউরনকে মেশিন নিউরনের ম্যাথম্যাটিক্যাল মডেলে রূপান্তরিত করেন, তার শুরুটি জটিলতাকে ভেঙে আরেক জটিলতায় প্রবেশের শুরু হলেও এখন সেটি একই সঙ্গে বায়োলজিক্যাল জটিলতাকে সরল করে ভেঙে মেশিন জটিলতাকেও সরল করে আনার চেষ্টা চলছে। এখন যত বেশি মস্তিষ্ককে বুঝতে পারবে, ততবেশি সহজ মেশিন তৈরি করতে পারবে, যা দিয়ে মস্তিষ্ক যা করে, মেশিনও তাই করবে। মেশিন মানে কম্পিউটেশনাল নেটওয়ার্ক। মোটা দাগে বললে একটি মানব বুদ্ধিমত্তা, আরেকটি আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

নিউরনের ডেনড্রাইট অংশের কাজ সিগন্যাল ইনপুট বা যোগানো, আর সে ইনপুট থেকে সিদ্ধান্ত আকারে যেটি যাবে, সেটি যায় এক্সন দিয়ে, যাকে বলা হয় আউটপুট। বায়োলজিক্যাল নিউরনের ইনপুট আউটপুটের এই খেলায় অনেকগুলো লেয়ার বা স্তর কাজ করে। এবং এই লেয়ারগুলোতে সিগনালের বিন্যাস যেমন হয়, তার উপর ভিত্তি করে সমাপ্তির বা ফলাফলের সিদ্ধান্তটি হয়। নিউরো বিজ্ঞানীরা এই লেয়ারের মধ্যে কি ঘটে, কেমন করে ঘটে, এখন তা জানার চেষ্টা করছে। এই জানাটি যত স্পষ্ট হবে তত বেশি আর্টিফিশিয়াল কম্পিউটেশনাল নেটওয়ার্কের লেয়ার তৈরি করে সে লেয়ারের মধ্যে একই মেথড প্রয়োগ করে একই আউটপুট পাওয়া যাবে।

সময়ে এমন করে মস্তিষ্কের একটি সিঙ্গেল সেল নিউরনের কাজের পদ্ধতি জানার মধ্যে দিয়ে এমন এমন জটিল যন্ত্রপাতি বের হবে, যা দিয়ে মানব মস্তিষ্ক যে কাজ অনেক মাথা খাটিয়ে করতে চেষ্টা করবে, মেশিন সেটি মিলি সেকেন্ডে সমাধা করবে। সামনে মানব মস্তিষ্ক নয়, মেশিন মস্তিষ্কই মানব মস্তিষ্ককে চালাবে।

ডা. অপূর্ব চৌধুরী

লেখক : চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও

বিজ্ঞান লেখক, লন্ডন, ইংল্যান্ড

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *